জার্মানির ডায়রিঃ১৪ অন্যরকম একুশ
Contents
১
ইন বক্সে ইদানীং অনেক স্প্যাম ইমেইল আসে, সেদিন সকালের ইমেইলটাকেও না পড়েই প্রায় মুছে দিচ্ছিলাম। জার্মানির একটা জাতীয় রেডিও থেকে “হের আদনান সাদেক”কে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে একটা বক্তৃতা দেবার জন্য, পাঠিয়েছে কোন এক “সুজানা”। দুই বর্ণ জার্মান বললেই হাত পা কেঁপে জ্বর আসে, জার্মান রেডিওর আর কাজ নাই, আমাকে দিতে হবে বক্তৃতা! ইয়াহু মেইল বদলে অন্য সার্ভিস ব্যবহারের সময় চলে এসেছে, খালি হাবিজাবি স্প্যাম।
মাঝখানে একবার প্রাইভেট হেলথ ইনস্যুরেন্সের জন্য কোন এক ওয়েব সাইটে ফর্ম পূরণ করেছিলাম। সেই থেকে নিয়মিত স্টেফানি, ক্লাউডিয়া ইত্যাদি সুরেলা নামের জার্মান ললনাদের থেকে নিয়মিত স্প্যাম আসে। এইসব ইমেইলের বিষয়বস্তু অত্যন্ত লোভনীয়, একবার ক্লিক করে ঢুকে দেখতেই হবে এমন। তারপরও সুজানা নামের অপরিচিতা ললনার ইমেইল, একবার ভেতর না দেখেই মুছে দেওয়া ঠিক হচ্ছে না ভেবে ক্লিক করেই ফেললাম।
ইমেইল পড়ার পর বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা সত্যি সত্যি ভয়াবহ। রেডিও সারল্যান্ড ষ্টেটের এসআর থ্রির মডারেটর সুজানা পুরো অনুষ্ঠান সূচী পাঠিয়ে দিয়েছে। আমি যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি, তাই প্রধান অতিথি অনুষ্ঠান উদ্বোধনের পরপরই কথা বলতে হবে। সময় ছয় মিনিট, রেডিওতেও সম্প্রচার হবে। একটু সাজিয়ে সুন্দর করে বললে নাকি ভাল হয়।
২
একুশে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩। ফ্রাঙ্কফুর্ট, জার্মানি।
স্থানীয় বাংলাদেশী ছাত্ররা ফ্রাঙ্কফুর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস নিয়ে একটা অনুষ্ঠান করছে, এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকেও সাহায্য করা হয়েছে বিনামূল্যে মিলনায়তন, পোস্টারিং সহ বিভিন্ন খরচ দিয়ে। উদ্দেশ্য অন্য দেশের ছেলেমেয়েদেরকে আকর্ষণ করা- কেন ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস -সেই ইতিহাস জানিয়ে দেওয়া।
আয়োজকদের মধ্যে খুব চটপটে একটা ছেলে আছে। সে আমাকে ফেসবুকে জানাল, মারাত্মক একটা প্রোগ্রাম আয়োজন হয়েছে। দূরে থাকলেও অবশ্যই যেন আসি, চারদিক থেকে কয়েকশ লোকজন আসছে, এদের মধ্যে বেশীরভাগই জার্মানিসহ অন্যান্য দেশের। এই অনুষ্ঠান সফল ভাবে হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে একটা একুশের স্মৃতি ফলক স্থাপন করার প্রতিশ্রুতি পর্যন্ত দিয়েছে ইউনিভার্সিটির কর্তৃপক্ষ।
অন্য কিছু না, শুধু জার্মানির একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ফলক হতে পারে, এই ভেবে ফ্রাঙ্কফুর্ট চলে এলাম।
অনুষ্ঠান শুরু হল দুপুরের পর। প্রচণ্ড ঠাণ্ডা সেদিন, মাইনাস ৫ এর মতো তাপমাত্রা। চারদিকে ধবধবে বরফে ঢাকা। আশানুরূপ না হলেও শ’খানেক মত মানুষ উপস্থিত হয়েছে। ছোট একটা শহীদ মিনার মত বানিয়ে সেখানে সবাই ফুল দিল।
সভাকক্ষে মূল অনুষ্ঠান শুরুর পর দেখা গেল দর্শক সংখ্যা পঞ্চাশও হবে না, বাকিরা উধাও। শোনা গেল, একই দিনে ফ্রাঙ্কফুর্টে একাধিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আয়োজনে সমান্তরাল ভাবে কয়েকটি অনুষ্ঠান চলছে। এবং কোন এক বিপক্ষ গোষ্ঠীর নানাবিধ প্রভাবশালীদের ফোন কলের প্রভাবে আমাদের অনুষ্ঠান থেকে অর্ধেকের বেশী লোকজন অন্য অনুষ্ঠানে চলে গেছেন। বিশাল হলঘর প্রায় খালি খালি লাগছে। মঞ্চে কোরাস শুরুর পর দেখা গেল স্টেজে গায়কদের সংখ্যা দর্শকের চেয়ে বেশী।
প্রভাবশালীরা শুধু পরিচিত বাংলাদেশী মহলে ফোন করেই ক্ষান্ত দিলেন না। তাদের অনেকেই ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশি ছাত্রদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে কেন তাদের রাজনৈতিক দলের ব্যানার ব্যবহার করা হল না, এবং কেন স্থানীয় বড় মুরব্বীকে প্রধান অতিথি করা হল না –এইসব নিয়ে অসন্তুষ্ট ছিলেন। ফলশ্রুতিতে অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে হটাত করে পুলিশ এসে হাজির। তাদের কাছে নাকি তথ্য আছে, একুশে ফেব্রুয়ারির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে কিছু তরুণ ছেলে পেলে ড্রাগস নিচ্ছে।

মানব বন্ধনে ২১,
আইডিয়াঃ আদনান সাদেক, ক্যামেরাঃ সুজয় পাল।
অনেকগুলো তরুণ ছেলে পেলে সারারাত খেটে খুঁটে একটা অনুষ্ঠান দাঁড় করিয়েছে, অনেকেই নিজের পকেটের পয়সা খরচ করেছে – জাতীয় একটা একুশের অনুষ্ঠানে একত্রিত হওয়া তো দূরের কথা, বরং দেশী মানুষেরাই অন্যের অনুষ্ঠানকে বানচাল করার জন্য সিদ্ধহস্ত!
৩
ফ্রাঙ্কফুর্ট অনুষ্ঠান প্রস্তুতির সময় একটা প্রেজেন্টেশন বানানোর জন্য গোগলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা নিয়ে সার্চ দিচ্ছিলাম। কি মনে করে জার্মানিতে এই জাতীয় কোন অনুষ্ঠান হয় কিনা দেখতে চাইলাম জার্মান ভাষায় কি-ওয়ার্ড লিখে। দেখলাম সারল্যান্ড ষ্টেটে সরকারী ভাবে ২০১২ থেকে এই দিনটিকে উদযাপিত হয়। এখানকার একটা আঞ্চলিক ভাষা প্রায় বিলুপ্তির পথে, সেই ভাষাকে টিকিয়ে রাখার জন্য স্থানীয় রেডিও এবং ইউনেস্কোর সহায়তায় এই অনুষ্ঠানের আয়োজন। একুশ নিয়ে জার্মানিতে অনুষ্ঠান হয়, অথচ আমরা জার্মানির বাংলাদেশীরা তার খবরও রাখি না।

ফ্রাঙ্কফুর্টে একুশের অনুষ্ঠান, ২০১৩
ফ্রাঙ্কফুর্ট অনুষ্ঠান শেষে রাতে আয়োজকদের একটা মিটিং মত হচ্ছিল। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা প্রবাহে সবারই মন কম বেশী খারাপ। সবাইকে একটু উজ্জীবিত করতে প্রস্তাব করলাম, আগামী বছর সারল্যান্ডে আমরা বাংলাদেশীরা জার্মানির এই অনুষ্ঠানে গিয়ে দেখতে পারি সেখানে কি হয়, এবং একই সাথে দেখা যেতে পারে তারা একুশকে কিভাবে মূল্যায়ন করছে। একুশ এখন আর শুধু আমাদের একার নয়, বরং সমস্ত বিশ্বের জন্য মাতৃভাষা দিবস।
দুই একজন উৎসাহ দেখাল। অনেকদিন পর একবার ওয়েব সাইট দেখে আয়োজকদের একটা ইমেইল পাঠালাম। “তোমরা একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করছি, তোমরা জান কি এই দিনে কি হয়েছিল?”
কোন উত্তর না পেয়ে অনেক দিন আগের সেই ইমেইল ভুলেই গিয়েছিলাম। অবশেষে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সুজানার ইমেইল পেয়ে আবার সব মনে পড়ল।
রেডিও মডারেটর সুজানা লিখেছে, একুশে ফেব্রুয়ারির উৎপত্তি বাংলাদেশ থেকে এটা জানলেও তারা জানে না কি হয়েছিল এই দিনে। ওয়েব থেকে যদিও সে পড়ে দেখেছে, তারপরও বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি যদি তাদের অনুষ্ঠানে থাকে এবং নিজ মুখে একুশের ইতিহাস নিয়ে বলে, তাহলে তারা খুবই আনন্দিত হবে।
৪
২১শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৪।
সার্ব্রুকেনের ২১শে অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গেলাম। আমি ছাড়া বাংলাদেশী তো দূরের কথা, বাকি সব সাদা চামড়ার জার্মান মানুষজন। একটু পরে আমি ছাড়াও আরেকজন নন-জার্মান পাওয়া গেল। ভদ্রলোক টেবিল ছেড়ে উঠে এসে আমার সাথে হাত মেলালেন। উনি সীমান্তবর্তী ফ্রান্সের সারেগুমেনাস শহরের সংস্কৃতি মন্ত্রী। তাদের শহরের একটা আদিবাসী ভাষার অধিকার নিয়ে ফ্রান্স সরকারের সাথে কিছু দ্বিমত প্রকাশ করতেই তার আগমন।
কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছি, সুজানার ভাব সাব দেখে মনে হচ্ছে আমাকে নিয়েই আসল অনুষ্ঠান হবে। একের পর এক ভয়াবহ রকমের মানুষজনকে নিয়ে এসে সে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকল। স্থানীয় সরকারের প্রতিমন্ত্রী, সার্ব্রুকেনের ইউনিভার্সিটির ভাষা বিভাগের প্রভাষক, স্থানীয় জাদুঘরের প্রধান। আমার দেবার মতন কোন পরিচয় নেই। সুজানা বলে, ও হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে এসেছে, এই দেশ থেকেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা পালিত হবার রীতি। এইটুকুতেই সবাই মুগ্ধ।
স্থানীয় একটা রেস্টুরেন্টের বিশাল হলঘরে ঘরোয়া ভাবে গোল হয়ে বসেছে শ’খানেক দর্শক। এক কোনায় রেডিওর রেকর্ডিং চলছে। তার ঠিক সামনেই আমন্ত্রিত অতিথিরা বসেছেন। আমাকেও সেখানে সবার সামনে বসানো হয়েছে।
যথারীতি অনুষ্ঠানের শুরুতে আমার ডাক পড়ল। দর্শকদের প্রবল করতালির মধ্যে সামনে এগিয়ে গেলাম।
[youtube_sc url=”http://www.youtube.com/watch?v=_qpcmoE3-Yg” title=”একুশের%20অনুষ্ঠানের%20জন্য%20বানানো%20ভিডিও%20প্রেসেন্টেশন”]
দুই রাত ধরে একুশের ইতিহাস পড়েছি। নিজেও সবকিছু জানতাম না। সেই ১৯৪৮ থেকে উর্দুকে চাপিয়ে দিতে পাকিস্তানের অপচেষ্টা থেকে শুরু করে অনেকগুলো বছরের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। ১৯৫২ সালের জানুয়ারিতে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দানা বেঁধে ওঠা আন্দোলন, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে মিছিল করার সিদ্ধান্ত, সালাম বরকত রফিকের রক্তে রক্তাক্ত হল একুশ। অতঃপর বাঁধভাঙ্গা জন মানুষের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত বাংলাদেশে। অনেক বছরের আন্দোলন সফল হয়েছে তারও অনেক পরে, ১৯৫৬ তে এসে যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে সংবিধানে বাংলা ভাষাকে জাতীয় ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হল।
রফিক সালামের পরবর্তী বংশধরেরা (কাকতালীয় ভাবে তাদের নামও রফিকুল ইসলাম এবং আব্দুস সালাম) কানাডায় নব্বই দশকের শেষের দিকে জাতিসঙ্ঘের কাছে ২১ তারিখকে বিশ্ব ব্যাপী উদযাপনের প্রস্তাবনা তুললেন। তাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় ১৯৯৯ সালে ২১ স্বীকৃতি পেল ইউনেস্কো থেকে। ২০০০ সাল থেকে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হতে থাকল বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে।
৫
রাত ১১ টায় বাড়ির পথে যাত্রা শুরু হল, আবারও আড়াইশ’ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হবে। এই দেশের মানুষ অতীব ভদ্র। ছয় মিনিটের ভাঙা জার্মানে একুশের ইতিহাসে একাধিক বার করতালি পড়ল। ফেরার আগে বারবার করে ধন্যবাদ দেওয়া হল, এতদূর কষ্ট করে আসার জন্য। আমাদের এই গৌরবান্বিত ইতিহাস শুনে স্থানীয় অনেকেই এসে ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, তাদের হারিয়ে যেতে থাকা মাতৃভাষাকে ধরে রাখতে তারা নতুন প্রত্যয় পেয়েছেন।
বিদেশে অনেক বছর থেকে বাংলাদেশকে নতুন করে দেখেছি, এবং সেটা মূলত বিদেশীদের অবহেলিত চোখে। বাংলাদেশ প্রসঙ্গে মন্তব্য শুনেছি, পৃথিবীর গরীব তম দেশ বলে। বন্যা আর দুর্নীতির পাশে নতুন জুটেছে গার্মেন্টস ধ্বসের পরিচয়। জার্মানিতে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অধিকাংশের পরিচয় রাজনৈতিক আশ্রয়ী হিসেবে। এইসব পরিচয় থেকে বের হয়ে এসে, এই প্রথম শুধুমাত্র বাংলাদেশী হিসেবে অভূতপূর্ব সন্মান পেলাম। বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বললাম আমাদের গর্বের ইতিহাস। যে ইতিহাস আজকে পৃথিবীর সব মানুষকে তাদের প্রাণের মাতৃভাষার কাছে নিয়ে এসেছে। ২১শে ফেব্রুয়ারি শুধু ভাষা শহীদদের স্মরণ করার দিন নয়, বাংলাদেশ নিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোরও দিন।
ফিরতি পথে হেডলাইটের আলোয় সামনের গাঢ় অন্ধকারে সতর্ক দৃষ্টি মেলতে মেলতে বারবার করে মনে পড়তে থাকে ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া শহীদদের কথা। একুশের রাতে বহু বছর আগে ঠিক এমন একটা সময়ে হয়তো তাদের জানাজা পড়া হচ্ছিল। তাদের প্রাণহীন নিথর শরীর বীজ বুনে দিয়ে গেল আমাদের প্রাণের ভাষার। সেই ভাষায় তাদের কথা কল্পনা করে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। পথের ক্লান্তি মুছে বুকের ভেতরে প্রবল আলোড়ন অনুভব করি, “আমি কি ভুলিতে পারি!”
আদনান সাদেক, ২০১৪
অন্যান্য পর্ব ও লেখকের কথা
Adnan Sadeque
http://bsaagweb.de/germany-diary-adnan-sadeque
লেখক পরিচয়ঃ
http://bsaagweb.de/adnan-sadeque
Latest posts by Adnan Sadeque (see all)
- জার্মানির ডায়েরিঃ২৪ “ফিহা এবং কিছু সমীকরণ” - November 30, 2018
- জার্মানির পথেঃ১৬ জার্মানিতে মাইগ্রেশন, আসছে চমকপ্রদ নতুন আইন, ২০১৮ - November 21, 2018
- জার্মানিঃ “Das Beste, oder nichts” - January 23, 2018